জাতির অগ্রগতির মূল হাতিয়ার শিক্ষা। সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সহজ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চরম অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনা,ভুলত্রুটি সংশোধনে দীর্ঘসূত্রিতা এবং পাঠ্যবই সরবরাহে গাফিলতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। এই সংকটের ধারাবাহিকতায় বই সরবরাহ নিয়ে চলছে রীতিমতো হাহাকার। এরই মধ্যে নতুন বছরের জানুয়ারী পেরিয়ে ফেব্রুয়ারী শুরু হলেও বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা অনেকটা বন্ধ। শুরুতেই শিক্ষার্থীরা পাঠে এমন হোঁচট খাওয়ায় অভিভাবকরাও চিন্তিত। নতুন বছর শুরুর আগেই এক বছরের শিক্ষাপঞ্জি প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে এক বছরে কত দিন ক্লাস হবে, পরিক্ষা নেয়া হবে কবে এসবের উল্লেখ থাকে। যেসব স্কুল শিক্ষাপঞ্জির বাইরে আরো কিছু পরিক্ষা নেয়, তারাও বছরের শুরুতে সেটা ঠিক করে দেয়। অনেক স্কুল যারা ‘সিটি’ পরিক্ষা বা মাসিক পরীক্ষা নেয়, তারা বই দিতে না পারলেও শিক্ষার্থীদের পরিক্ষার তারিখ জানিয়ে দিচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা অন্য কোনো উপায় না পেয়ে দৌড়াচ্ছে প্রাইভেট শিক্ষকদের পেছনে।
প্রেস মালিকরা বলেছেন, এপ্রিলের আগে সব বইয়ের কাজ শেষ হওয়ার সুযোগ কম। আগে বছরের প্রথম দিন বই উৎসব করা হলেও সব বইয়ের কাজ শেষ করতে ফেব্রুয়ারি মাস লেগে যেত। তবে নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ বইয়ের কাজ শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এ বছরের ঘটনা উল্টো। এ পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বই পেলেও চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির মাত্র তিনটি বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। কিছু ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী সেটাও পায়নি।
পাঠ্যবই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ কমেছে। শিক্ষকদের বই ডাউনলোড করে পড়াতে বলা হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে কপি না থাকায় তাতে কারো আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না। বেশির ভাগ স্কুলে এত দিন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চললেও সেটাও শেষের পথে। যেসব শিক্ষার্থী খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে না তারাও স্কুলে আসছে না।
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, আমরা বই ছাপা কার্যক্রম শুরু করেছি দেরিতে। বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। সিলেবাস,কারিকুলাম নতুন করে করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
এনসিটিবি সূত্র মতে, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার কোটি ৩৪ লাখ তিন হাজার ২৮৩। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের দুই কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫ কপি বই। মাধ্যমিক পর্যায়ের দুই কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। এ ছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে আট হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা বই ছাপা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনসিটিবি সবচেয়ে বেশি অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে ছাপার কাগজ নিয়ে। চাহিদামতো ৪০ কোটি বই ছাপাতে প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার টন কাগজ। দেশে কাগজের এই সক্ষমতা আছে কি না সেটা তারা বিবেচনায় নেয়নি। ডিসেম্বর শেষে ছাপাখানাগুলো একসঙ্গে কাজ শুরু করতে গেলে কাগজের সংকট দেখা দেয়। ফলে কাজ থেমে যায়। এ ক্ষেত্রেও এনসিটিবি দায় চাপায় অন্যদের ওপর। ৪০ কোটি বই ছাপানোর জন্য যে পরিমাণ কাগজ প্রয়োজন, তা দেশের মিলগুলোর উৎপাদনে তিন মাসের মতো সময় লাগবে। আর যদি আমদানি করতে হয় তবে তা তিন মাস আগেই করা উচিত ছিল। উদ্ভুত এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয় কাগজ মিল মালিকরা। দফায় দফায় তারা কাগজের মূল্য বাড়ানোয় গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। এই সুযোগে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ৩৪৫ কোটি টাকারও বেশি। এখন বেশি দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পাচ্ছে না পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা ১১৬টি ছাপাখানা। ফলে অধিকাংশ ছাপাখানা কাগজ সংকটে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এ ক্ষেত্রেও এনসিটিবি সিদ্ধান্ত নিতে সময়ক্ষেপণ করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার থেকে বেশি কাজ দিয়েছে তারা। আবার সম্পাদনা কমিটি পাঠ্যবই সম্পাদনার কাজে দীর্ঘ সময় নিলেও আগের পাঠ্যবই ও এ বছরের পাঠ্যবই বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন কারিকুলামে কাঙক্ষিত পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং, বইয়ের কিছু ভুল-ভ্রান্তি ও অসঙ্গতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে।
জুলাই অভ’্যত্থানের পর মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, অর্ন্তর্বতী সরকার দ্রুত তাদের পড়ার ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। কিন্তু আদতে হচ্ছে তার উল্টো। মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এর আসল ভুক্তভোগী, যা তাদের মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থাৎ, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু শিক্ষাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে না, বরং তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও বাস্তব জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাও ব্যহত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
দেশের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে প্রতিটি সেক্টরে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিকভাবে গড়ে উঠছে কি-না কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ কীÑ এসব বিষয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। স্কুল,কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখার ব্যবস্থাপনা,মান এবং পরিবেশ নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অনেকেরই আচার-আচরণ,আনুগত্যশীলতা,পড়ালেখার মান এবং পড়ালেখার আগ্রহেও পরিবর্তন লক্ষণীয় মাত্রায় দৃশ্যমান হয়েছে। আগে যেভাবে পড়াশোনার ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ভারসাম্য ছিল, তার অবক্ষয় সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কেও এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভক্তি, স্নেহ-ভালোবাসায়ও প্রভাব পড়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ, দর্শন প্রভৃতি কারণে শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যেও এক ধরনের বিভেদ ও অসহিষ্ণু মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তারা নিজেদের মূল লক্ষ্য থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাঠে নামছে। কখনও রেজাল্টের দাবিতে, কখনও পরিক্ষা বাতিলের দাবিতে তারা সচিবালয় ঘেরাও করছে। রেজাল্ট কিংবা পরিক্ষা আগানো-পেছানোর বিষয়েও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠেছে। তারা যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক চেইন অব কমান্ড নষ্ট হচ্ছে। তরুণদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সঙ্গে আমাদের সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় যদি যথাযথভাবে ঘটে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা অনেকাংশে কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী তার স্বপ্নগুলো লালন করতে করতে পড়ালেখা যখন শেষ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি অর্জন করে তখনই শুরু হয় তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। অনেক ছোট ছোট যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সম্মুখীন হয় একটি বড় যুদ্ধের। আর এ যুদ্ধে যথাযথভাবে বিজয়ী হলেই কেবল তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় ঘটতে পারে।
আমাদের যে প্রত্যাশা সে অনুযায়ী শিক্ষাকাঠামো যথাযথভাবে সাজানো হচ্ছে কি না, নাকি গুণগত মান বিবেচনা না করে পরিমাণগত বৃদ্ধির প্রবণতায় ঝুঁকে পড়েছি। দেশে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তবে উচ্চশিক্ষার মান বাড়ছে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রচলিত উচ্চশিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই কর্মবাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সারা বিশ্বে কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এ বিষয়ে আমরা এখনও পিছিয়ে।
শেষে বলা যায় শিক্ষাব্যবস্থা কোনো পরিক্ষামূলক ব্যবস্থা নয়, যেখানে বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা চলতে থাকবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সবার আগে বিবেচনায় রেখে বই ছাপানো ও বিতরণের প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী করা দরকার।
লেখক : এম এ কবীর, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সভাপতি ঝিনইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply